যে একক অন্য কোনো এককের উপর নির্ভর করে না এবং একেবারে সম্পর্কশূন্য বা স্বাধীন তাকে মৌলিক একক বলে। যেমন দৈর্ঘ্য বা ভর বা সময়ের একক অন্য কোনো এককের উপর নির্ভর করে না। সুতরাং দৈর্ঘ্যের একক ভরের একক এবং সময়ের একক মৌলিক একক। এই তিনটিকে ভিত্তি করে যে একক গঠন করা হয় বা মৌলিক একক হতে যে একক পাওয়া যায় তাকে লম্ব বা যৌগিক একক বলে। উদাহরণস্বরূপ ক্ষেত্রফল মাপতে দৈর্ঘ্যকে প্রস্তু দিয়ে গুণ করতে হয়। যেমন- এক মিটার (m) দৈর্ঘ্য ও এক মিটার (m) প্রস্থবিশিষ্ট ক্ষেত্রের
ক্ষেত্রফল = 1 মিটার (m) x 1 মিটার (m) = 1 বর্গ মিটার বা 1m2।
এই বর্গ মিটারই ক্ষেত্রফল মাপার একক। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, দৈর্ঘ্যের একক জানা থাকলে, ক্ষেত্রফলের একক জানা যায়, তার জন্য নতুন কোনো এককের দরকার হয় না। অতএব ক্ষেত্রফলের একক যৌগিক একক। তেমনি আয়তন, বেগ, ত্বরণ, বল ইত্যাদির একক যৌগিক একক।
মৌলিক একক তিনটি যথা—
(ক) দৈর্ঘ্যের একক (Unit of length)
(খ) ভরের একক (Unit of mass) এবং
(গ) সময়ের একক (Unit of time)।
এই এককগুলি হবে নির্দিষ্ট, সুবিধাজনক ও অপরিবর্তনীয় অর্থাৎ গরমকালে কোনো দূরত্ব যদি মিটার হয়, 1 তবে শীতকালেও তা 1 মিটার হবে। সময় কিংবা চাপ ইত্যাদির প্রভাবে তাদের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
অবশ্য প্রশ্নও জাগে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন-এর আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে কোনো ভর, সময় ও দৈর্ঘ্য মহাজগতের সব স্থান হতে সমান হবে কী ?
1960 সালে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত একক এবং সংখ্যা লেখার কয়েকটি নিয়ম নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
(১) একক একবচনে লিখতে হবে, যথা km, কিন্তু (kms নয়)
(২) এককের শেষে ফুলস্টপ দেয়া যাবে না, যেমন km, কিন্তু (km. নয়)
(৩) দশমিক চিহ্ন দেয়ার নিয়ম 1.9, তবে অনেকে 1'9 এভাবেও লেখে।
(৪) দীর্ঘ সংখ্যা পাঠে সুবিধার জন্যে দশমিক স্থান হতে আরম্ভ করে ডানে বা বামে একত্রে তিনটি করে সংখ্যা লিখতে হবে।
অশুদ্ধ 24765'321 | শুদ্ধ 24,765'321 |
(৫) একক লেখার সময় প্রয়োজন মতো বিভক্তি চিহ্ন (/) যথা (N/m2) একবার মাত্র ব্যবহার করা চলে। তবে তা না করাই ভালো। যেমন N/m2 এর স্থলে Nm-2 লেখা উচিত।
(৬) এককের দশমাংশগুলো নিম্নলিখিতভাবে লিখতে হবে, যেমন
ডেসি (=10-¹)d
সেন্টি (= 10-2)c ইত্যাদি।
(৭) সাধারণ ব্যবহারে মিনিট, ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর ইত্যাদি চললেও বিজ্ঞানের সঠিক পরিমাপে এ ধরনের একক ব্যবহার করা অনুচিত।
উপরের তিনটি প্রাথমিক একককে প্রকাশ করার জন্য তিনটি পদ্ধতি আছে। এছাড়া পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রয়োজন উপযোগী অতিরিক্ত এক বা একাধিক প্রমাণ রাশি ও তার একক যুক্ত করে পরিমাপের আরও দুটি পদ্ধতি প্রচলিত আছে। পদ্ধতিগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো।
এ পদ্ধতিকে সংক্ষেপে সি. জি. এস. (C. G.S.) বা সেমি. গ্রাম সে পদ্ধতি বলা হয়।
এখানে,
সি. অক্ষরটি বুঝাচ্ছে - সেন্টিমিটার—দৈর্ঘ্যের একক
জি. অক্ষরটি বুঝাচ্ছে -গ্রাম—ভরের একক
এস. অক্ষরটি বুঝাচ্ছে -সেকেন্ড সময়ের একক
অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একক সেন্টিমিটার, ভরের একক গ্রাম এবং সময়ের একক সেকেন্ড। এই পদ্ধতিকে দশমিক পদ্ধতি (Decimal System) বলে ।
এই পদ্ধতিকে সংক্ষেপে এম. কে. এস. (M. K. S.) পদ্ধতি বলা হয়।
এখানে,
এম. অক্ষরটি বুঝাচ্ছে মিটার - দৈর্ঘ্যের একক
কে অক্ষরটি বুঝাচ্ছে -কিলোগ্রাম ভরের একক
এস. অক্ষরটি বুঝাচ্ছে -সেকেন্ড সময়ের একক।
অর্থাৎ, এ পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একক মিটার, ভরের একক কিলোগ্রাম এবং সময়ের একক সেকেন্ড ।
বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতির এককের প্রচলন আছে। কোথাও এফ. পি. এস. পদ্ধতি, কোথাও সি. জি. এস. পদ্ধতি, আবার কোথাও এম. কে. এস. পদ্ধতি। পরিমাপের এই বৈষম্যের জন্য বাস্তব ক্ষেত্রে বেশ অসুবিধা হয়। এই অসুবিধা দূর করার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা পরিমাপের উপরোক্ত তিনটি পদ্ধতি ছাড়াও 1960 সালে পরিমাপের একটি নতুন পদ্ধতি প্রচলন করেন। এটাই আন্তর্জাতিক পদ্ধতির একক বা এস, আই. একক। পূর্বের এম. কে. এস. পদ্ধতির সাথে আরও কয়েকটি প্রমাণ রাশি ও উহার একক যোগ করে এই পদ্ধতি তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাশি এবং তাদের একক ও প্রতীক নিচের তালিকায় উল্লেখ করা হলো। এই পদ্ধতিতে সর্বমোট নয়টি রাশি আছে।
ক্রমিক সংখ্যা | রাশি | একক | এককের প্রতীক |
1. | দৈর্ঘ্য | মিটার | m |
2. | ভর | কিলোগ্রাম | Kg |
3. | সময় | সেকেন্ড | s |
4. | তাপমাত্রা | ডিগ্রী-কেলভিন | k |
5. | বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা | অ্যাম্পিয়ার | A |
6. | কোণ (দ্বিমাত্রিক) | রেডিয়ান | rad |
7. | কোণ (ত্রিমাত্রিক) | স্টেরিডিয়ান | St |
8. | দীপন মাত্রা | ক্যান্ডেলা | cd |
9. | পদার্থের পরিমাণ | মোল | mole |
এটি প্রণিধানযোগ্য যে, আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে এ নয়টি মূল এককের সাহায্যে বস্তু জগতের পরিমাপ বিষয়ক সর্বপ্রকার একক পাওয়া যায়।
এ পদ্ধতিতে লম্ব একক এবং তাদের প্রতীক নিম্নে বর্ণিত হলো।
ক্রমিক সংখ্যা | রাশি | একক | এককের প্রতীক |
1. | বল | নিউটন | N |
2. | শক্তি | জুল | J |
3. | ক্ষমতা | ওয়াট | W |
4. | তড়িতাধান | কুলম্ব | C |
5. | বৈদ্যুতিক রোধ | ও'ম | Ω |
6. | বৈদ্যুতিক বিভব | ভোল্ট | V |
7. | কম্পাঙ্ক | হার্জ | Hz |
পরিমাপের পূর্বোক্ত পদ্ধতি ছাড়াও বলবিদ্যা, তড়িৎ ও চুম্বকের সমি প্রয়োজনে আর একটি নতুন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এর নাম মিটার কিলোগ্রাম সেকেন্ড-অ্যাম্পিয়ার পদ্ধতি। সংক্ষেপে একে M. K. S. A. System বা এম. কে. এস. এ. পদ্ধতি বলা হয়। এটা একটি সুসংগত পদ্ধতি। এটি চারটি প্রমাণ একক নিয়ে গঠিত।
আমরা জানি, মৌলিক একক তিনটি যথা-
(ক) দৈর্ঘ্যের একক,
(খ) ভরের একক এবং
(গ) সময়ের একক।
(ক) দৈর্ঘ্যের একক : সি. জি. এস. পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একক সেন্টিমিটার। 90 ভাগ প্লাটিনাম ও 10 ভা ইরিডিয়ামের সংকর নির্মিত দণ্ডের উপর দুইটি নির্দিষ্ট দাগের মধ্যবর্তী দূরত্বকে আন্তর্জাতিক মিটা (International Proto-type Metre) বলে। আন্তর্জাতিক ওজন ও পরিমাপ সংস্থার রক্ষণশালায় দন্ড বিশেষভাবে রক্ষিত আছে। তাপমাত্রার বৃদ্ধি বা হ্রাসের প্রভাব যাতে এর উপর না পড়ে, সেজন্য দন্ডটিকে 0° তাপমাত্রায় রাখা হয়। এই দূরত্বের একশ ভাগের এক ভাগকে এক সেন্টিমিটার বলে।
সি. জি. এস. এবং এম. কে. এস. ও আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের এককের তালিকা :
10 মিলিমিটার (মিমি)= 1 সেন্টিমিটার (সেমি) 10 সেন্টিমিটার= 1 ডেসিমিটার (ডেমি) 10 ডেসিমিটার (dm) = 1 মিটার (মি) 10 মিটার (m)= 1 ডেকামিটার (ডেকামি) | 10 ডেকামিটার (Dm) = 1 হেক্টোমিটার (হেমি) 10 হেক্টোমিটার (Hm)= 1 কিলোমিটার (কিমি) 10 কিলোমিটার (Km) = 1 মিরিয়া মিটার (মিরিয়ামি) |
এককের উপগুণিতক
| উপসর্গ | সংকেত | অর্থ | এককের কতগুন |
ডেসি (Deci) সেন্টি ( Centi) মিলি (Mili) মাইক্রো (Micro) ন্যানো (Nano) পিকো (Pico) ফেমটো (Femto) অ্যাটো (Ato) | d c m n p f a |
| 10-1 (দশাংশ) 10-2 (শতাংশ) 10-3 (সহস্রাংশ) 10-6 (নিযুতাংশ) 10-9 অংশ 10-12 10-15 অংশ 10-18 অংশ | |
এককের গুণিতক | ডেকা (Deca) হেকটো (Hecto) কিলো (Kilo) মিরিয়া (Myria) মেগা (Mega) গিগা (Giga) টেরা (Tera) পেটা (Peta) এক্সা (Exa) | da h k Ma M G T P E |
| 101 গুন 102 (শত গুণ) 103 (হাজার গুণ) 104 (দশ হাজার গুণ) 106 (দশ লক্ষ গুণ) 109 গুণ 1012 গুণ 1015 গুণ 1018 গুণ |
গাণিতিক উদাহরণ
১। এক টনে কত কিলোগ্রাম (kg) ?
আমরা জানি,
1 টন = 2.240 পাউন্ড
= 2.240 x 453.6g
= kg
= 1.016 kg
২। 1 গ্যালন কত ঘন মিটার (m-3)-এর সমান ?
আমারা জানি,
1 গ্যালন = 277 inch3 ও 1 inch = 2.54 cm
:• 1 inch3 = (2'54 cm)3 = 16.39 cm3 = 16.39 x 10-6 m3
কাজেই, 1 গ্যালন =277 x 16'39 x 10-6 m³ = 4'54 x 10-3 m³
মাত্রা (Dimension) : আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি যে উৎপত্তি অনুসারে রাশি (দুই) প্রকার—একটি মৌলিক রাশি এবং অপরটি যৌগিক রাশি। আমরা আরও জানি, যে সকল রাশি অন্য কোনো রাশির উপর নির্ভর করে না, তাদেরকে মৌলিক রাশি বলে। এখন আমরা আলোচনা করব— কোনো রাশির 'মাত্রা' বলতে কী বুঝি ? কোনো রাশির মাত্রার নিম্নলিখিত যে কোনো একটি সংজ্ঞা দেয়া যেতে পারে—
উদাহরণস্বরূপ দৈর্ঘ্য একটি রাশি। ফুট বা সেমি বা মিটার তার মৌলিক একক। দৈর্ঘ্য এবং এর মৌলিক এককের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য 'L' সংকেত ব্যবহার করা হয়। এখানে L দৈর্ঘ্য বুঝায়। আবার ফুট, বা সেমি বা মিটার এরাও প্রত্যেকে দৈর্ঘ্য প্রকাশ করে। সুতরাং 'L' অক্ষর দৈর্ঘ্য এবং এর মৌলিক এককের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের একটি সংকেত। অতএব দৈর্ঘ্যের মাত্রা L ।
পদার্থবিজ্ঞানের তিনটি মৌলিক রাশি হলো দৈর্ঘ্য, তর এবং সময়। এদের মাত্রা যথাক্রমে L. M এর T। দৈর্ঘ্যকে L দ্বারা প্রকাশ করা হয় বলে দৈর্ঘ্য এক L-মাত্রিক রাশি, ক্ষেত্রফল হলো দৈর্ঘ্য × দৈর্ঘ্য = L×L =L2 । অতএব ক্ষেত্রফল দুই L-মাত্রিক রাশি। অনুরূপভাবে, আয়তন হলো দৈর্ঘ্য × দৈর্ঘ্য × দৈর্ঘ্য = L×L×L = L3 । ।অতএব আয়তন হলো তিন L-মাত্রিক রাশি ইত্যাদি। এখানে [L], [L2],[L3]-কে মাত্রিক বা মাত্রা সমীকরণ (Dimensional equation) বলে। মাত্রা সমীকরণের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে :
পদার্থবিজ্ঞানে মাত্রা সমীকরণের ভূমিকা অপরিসীম। নিম্নে এর ভূমিকা বা প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হলো :
(১) এক পদ্ধতির একককে অন্য পদ্ধতির এককে রূপান্তর করা যায়।
(২) সমীকরণের নির্ভুলতা যাচাই করা যায়।
(৩) বিভিন্ন রাশির সমীকরণ গঠন করা যায়।
(৪)কোনো ভৌত রাশির একক নির্ণয় করা যায়।
(৫) কোনো ভৌত সমস্যার সমাধান করা যায়।
মাত্রা সমীকরণের বহুল প্রয়োগ থাকা সত্ত্বেও এর কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন-
(১) কেবল L,M ও T এই তিনটি মৌলিক রাশির উপর ভিত্তি করে আমরা মাত্রা সমীকরণ গঠন করি। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত রাশি যদি এই তিন রাশি অপেক্ষা বেশি রাশির উপর নির্ভরশীল হয়, তবে সেই অজ্ঞাত রাশির মাত্রা সমীকরণ আমরা গঠন করতে পারি না। যেমন তাপ পরিবাহিতাংকের মাত্রা সমীকরণ কেবল L. M ও T দ্বারা প্রকাশ করা যায় না, কারণ এটি আরও একটি রাশি যথা তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল।
(২) এছাড়া মাত্রিক পদ্ধতিতে কোনো মাত্রাবিহীন রাশি যথা 'ধ্রুবক'-এর মান বের করা যায় না।
নিচে কয়েকটি মাত্রা সমীকরণ দেখানো হলো।
(ক) দৈর্ঘ্য] = [L]
(গ) [ভর] = [M)
(গ) [সময়] = (T)
(ঘ)[বেগ] = = = [LT-2]
(ঙ) [ত্বরণ] = [বেগের পরিবর্তন/ সময়] = [LT-1/T]=[LT-2]
(চ) আয়তন (দৈর্ঘ্য × প্রস্থ × উচ্চতা)= [L][L][ L] = [L3]
(ছ) [বল] = [ভর × ত্বরণ] = [M][LT-1]=[MLT-1]
(জ)[ভর -বেগ)] = [ভর x বেগ] = [M][LT-1]= [MLT-1]
(ঝ) [ক্ষমতা] = [কাজ/সময়] = [ML2T-2/T][L]=[ML2T-3]
(ঞ) [গতিশক্তি] = [ভর] ×[বেগ২]= [M][LT-1]2=[ML2T-2]
(ট) [বলের ভ্রামক] =[বল]×[লম্ব দূরত্ব] =[MLT-2/L]=[MLT-2]
১। নিউটনের সূত্র অনুসারে গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বেগ V = , এখানে p = গ্যাসীয় চাপ, এবং D = ঘনত্ব। মাত্রা বিবেচনায় সমীকরণটি সঠিক কি না যাচাই কর।
বামপক্ষ, V = [LT-1]
ডানপক্ষ, ==[LT-1]